জনমত নিউজ ডেস্ক : ঘাম দেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পরিবেশ, পরিস্থিতি, বয়স ও লিঙ্গ ভেঙ্গে একেক জনের ঘাম হয় একেক রকম। আবার যারা দৈহিক পরিশ্রম করেন তাদের ঘেমে যাবার প্রবণতা থাকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। যেসব নারীরা রান্নাঘরে চুলার কাছে কাজ করেন বেশী, অন্যদের তুলনায় তারা ঘেমে যান বেশী। আমাদের দেহের পুরো ত্বকে রয়েছে অসংখ্য ঘাম গ্রন্থি। এদেরকে খালি চোখে দেখা যায় না। এই গ্রন্থিগুলো দেহের দূষিত পদার্থকে ঘামের মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়।
আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী পুরুষদের ঘেমে যাবার কারণ থাকে ভিন্ন। দেশের বাহিরের নারীরা পুরুষদের মত ঘর ও বাহিরের কাজ করেন। আর আমাদের দেশের নারীরা চাকরি করার পাশাপাশি ঘরের কাজও সমানভাবে করেন। দৈহিক পরিশ্রম বেশী হলে যে কোন মানুষেরই ঘাম হয় বেশী। জন্মগতভাবে নারীদেহে পুরুষের তুলনায় ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ বেশী থাকে। ফ্যাট বা লিপিড (খরঢ়রফ) অর্থাৎ চর্বি দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একটু হাটাচলাতেই নারীদেহে তাপ তৈরী হয় পুরুষ দেহের তুলনায় বেশী। বিশেষতঃ যাদের বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বেশী।
আর যেসব নারী বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী অধিক ওজন সম্পন্ন, রক্তে চিনির মাত্র স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ মাত্রার কোলস্টেরলে ভুগছেন তাদের ঘেমে যাবার প্রবণতা থাকে অধিক বেশী। রক্তে কোলস্টেরল (ঈযড়ষবংঃবৎড়ষ) বেড়ে যাওয়া মানে রক্তে চর্বি বা ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
ফাস্টফুড, ঘি, মেয়োানিজ দেয়া খাবার বা অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার খেলে এবং দৈহিক পরিশ্রম কম হলে দেহে চর্বি জমে যাবে যে কোন বয়সের মানুষের। এতে ঘেমে যাবার পরিমাণ আরো বাড়বে। যেসব নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল (ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল) বছরের পর বছর যাবৎ খায় এবং খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওজন বেড়ে যায়। ডায়াবেটিক রোগীীরা হঠাৎ করে বেশী ঘামতে শুরু করলে দ্রুত রক্তের চিনির মাত্রা দেখতে হবে। রক্তে সুগারের মাত্রা বেশী কমে বা বেড়ে যাওয়াটা খারাপ। ঘাম কমানোর জন্য ওজন কমাতে হবে। পারিবারিক গঠনগত কারণেও মানুষের ওজন ও ঘাম বেশী হতে পারে।
অধিক ওজন সম্পন্ন পুরুষদেরও খেয়াল করা উচৎ নিজের প্রতি। আমাদের দেশে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় ঘরের বাহিরে কাজ করেন বেশী। তাই স্বাভাবিকভাবে তারা ঘেমে যান বেশী। খেয়াল রাখুন ঘাম জমে যেন ফাংগাল ইনফেকশান বা বুকে কফ জমে না যায়। ফাংগাল ইনফেকশান মানে হলো এক ধরণের ফাংগাস (ঋঁহমঁং) নামের অনুজীব। যারা দেহে রোগজীবাণু সৃষ্টি করে, পরিণামে তৈরী হয় নানান রকম অসুখ। যা কখনোই কাম্য নয়।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য চারিপাশের আবহাওয়া, পরিবেশ, দৈহিক গড়ন বুঝে পোষাক নির্ধারণ করতে হবে। পোষাক নরম কাপড়ের, ঢিলা হওয়া উচিৎ, যেন ভেতরে খুব সহজে বাতাস ঢুকতে পারে। নিয়মিত গোসল ও প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার খাওয়াটা জরুরী। এতে দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
ঘেমে যাবার প্রসঙ্গে রাজধানীর (ঢাকা) স্কয়ার হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন ও এন্ডোক্রাইনোলোজির (ঊহফড়পৎরহড়ষড়মু) অ্যাসোসিয়েট/সহযোগী কনসালটেন্ট ডাঃ প্রতীক দেওয়ান বলেন, “স্বাভাবিক ঘেমে যাবার সাথে হরমোনের কোন সম্পর্ক নাই। তবে কেউ অতিরিক্ত ঘামলে এবং দুর্গন্ধযুক্ত হলে অবশ্যই হরমোনের পরীক্ষা করানো উচিৎ। কারণ দেহের থাইরয়েড গ্রন্থির এক ধরণের হরমোন অতিরিক্ত কমে গেলে মানুষের ঘামের পরিমাণ বাড়ে। তবে বেশী ঘেমে যাবার জন্য সব সময হরমোন দায়ী নয়। হঠাৎ করে রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গেলে, দীর্ঘ বছর যাবৎ ডায়াবেটিস রোগে ভুগলে দেহের ¯œায়ুগুলো দূর্বল হয়ে মানুষ ঘামে বেশী। দেহের গড়ন, পরিবেশ পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার বিরুদ্ধে পোষাক হলে ঘামের পরিমাণ বাড়ে। আর নারীদের মাসিক চির তরে বন্ধ হবার পরে হট ফ্ল্যাশ (যড়ঃ ভষধংয) হয়। হট ফ্ল্যাশ হলে মুখে, দেহে, মাথাতে গরম লাগে বেশী। এই সময় অধিকাংশ নারীরা ঘামে বেশী।
সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না হলে ঘামের সাথে ব্যাকটেরিয়া যুক্ত হয়ে তৈরী হয় দূর্গন্ধ। দীর্ঘদিন ব্যাকটেরিয়া জমে নানান ধরণের চর্মরোগ হয়।
ঘামের দূর্গন্ধ দূর করার উপায়
(১) নিয়মিত পরিষ্কার পানিতে গোসল, বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক রাখা, রক্তচাপ ও রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা ভীষণ জরুরী।
(২) ঘেমে যাবার প্রবণতা বেশী থাকলে পরিধেয় বস্ত্র নিয়মিত পরিষ্কার করুন। সপ্তাহে বা মাসে অন্তত একদিন কাপড়ে স্যাভলন বা ডেটল দিন।
(৩) চুলার কাছে কাজ বেশী থাকলে খেয়াল রাখুন রান্নাঘরে যেন পর্যাপ্ত আলো বাতাস ঢুকে। রান্নাঘরে ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলে খুব ভালো। মাঝে মাঝ মুখ ধুয়ে ফেলুন। এতে গরম লাগার পরিমাণ কমে।
(৪) গোসলের পানিতে কয়েক ফোটা গোলপজল বা গোলাপের পাপড়ি মিশিয়ে নিন। এতে দেহে সুগন্ধ থাকবে অনেকক্ষণ।
(৫) নিয়মিত ব্যবহার করুন পারফিউম, বডিস্প্রে, সুগন্ধযুক্ত পাউডার ও ডিওডোরেন্ট।
(৬) খেতে হবে টাটকা খাবার। বাসি, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এতে অল্প ঘামে দ্রুত ব্যাকটেরিয়া বাসা বাধে। ফলে গন্ধ হয় বেশী।
(৭) প্রতি বছর বিশেষত মেনোপোজ (মাসিক বন্ধ হওয়াকে বলে মেনোপোজ) হবার পরে নিয়মিত হরমোন পরীক্ষা করাবেন। এই সময় অনেকের দেহে হরমোন অসাম্যাবস্থা তৈরী হয়।
(৮) প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। এতে দেহের রোগ জীবাণু মূত্রের সাহায্যে বাইরে বের হয়ে যায়।
(৯) ঘেমে যাবার পরেই গোসল করবেন না বা সাথে সাথে ঠান্ডা পানি খাবেন না। ঘাম মুছে কিছু সময় বিরতি দিয়ে গোসল করুন বা ঠান্ডা খান।
(১০) দেহের অবাঞ্ছিত লোম অপসারণ করুন। পরিচ্ছন্নতার অভাবে লোমকূপের গোড়াতে রোগ জীবাণু জমে, ত্বকে সঠিকভাবে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না, ত্বক হয়ে ওঠে উজ্জ্বলতাহীন ও কালচে।
(১১) ৬ মাস পর পর সম্ভব হলে প্রতি বছর হরমোন, পুরো পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রক্ত পরীক্ষা করান। সেই সাথে বুকের ই.সি.জি (হৃৎপিন্ডের পরীক্ষা) করানোটা ভীষণ জরুরী। কারণ নিজের অজান্তেই হার্টের অসুখ হতে পারে। কিছু হার্টের, হরমোনের ও রক্তের অসুখ আছে, যেগুলোতে মানুষ অতিরিক্ত ঘেমে যায়।
(১২) অনেকেই ঘামে ভিজে যাওয়া কাপড় বাতাসে শুকিয়ে আবার পরিধান করেন। এই অভ্যাসটা পরিহার করুন। ঘামে ভিজে যাওয়া কাপড় অবশ্যই ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ ঘামের সাথে শরীরের অনেক রোগ জীবাণু মিশে থাকে।
(১৩)যাদের ত্বকে এ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা রয়েছে তাদেরকে আরো ঘাম মুক্ত থাকতে হবে।
সামান্য কিছু সতর্কতা আপনাকে করবে ঘাম মুক্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর। আর সেই সাথে আপনি হবেন রোগমুক্ত।